কবিতা গুচ্ছ

আসমানী কবিতা জসীম উদ্‌দীন | Asmani kobita

আসমানী

                     – জসীম উদ্‌দীন

আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,

রহিমন্দীর ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।

বাড়ি তো নয় পাখির বাসা-ভেন্না পাতার ছানি,

একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।

একটুখানি হওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,

তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।

 

পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক’খান হাড়,

সাক্ষী দেছে অনাহারে কদিন গেছে তার।

মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি

থাপড়েতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি।

পরণে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,

সোনালী তার গার বরণের করছে উপহাস।

ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি,

সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি।

বাঁশীর মত সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে,

হয়নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে।

 

আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে

ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল-বিল-বিল করে।

ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,

সেই জলেতে রান্না খাওয়া আসমানীদের চলে।

পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার,

বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।

খোসমানী আর আসমানী যে রয় দুইটি দেশে,

কও তো যাদু, কারে নেবে অধিক ভালবেসে?



কপোতাক্ষ নদ কবিতা | মাইকেল মধুসূদন দত্ত

কপোতাক্ষ নদ

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

 

সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।

সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে

শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে

জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।

বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে

কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে

দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।

 

আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে

প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে

বারি রূপ কর তুমি এ মিনতি গাবে

বঙ্গজ জনের কানে সখে-সখারিতে।

নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে

লইছে যে নাম তব বঙ্গের সঙ্গীতে।



আঠারো বছর বয়স কবিতা | সুকান্ত ভট্টাচার্য

আঠারো বছর বয়স

           সুকান্ত ভট্টাচার্য

আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ

র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,

আঠারো বছর বয়সেই অহরহ

বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।

 

আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়

পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,

এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-

আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।

 

এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য

বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,

প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য

সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।

 

আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর

তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,

এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর

এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।

 

আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার

পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,

দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার

ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।

 

আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে

অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,

এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে

এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।

 

তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,

এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,

বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী

এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।

 

এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়

পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,

এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-

এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।।